সেশনজট থেকে বৈষম্য - শুধু সনদ নয়, চাই সময়োপযোগী শিক্ষা। ডিগ্রি কোর্সের সমস্যা ও সম্ভাব্য সমাধান।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত ডিগ্রি (পাস) কোর্সটি দেশের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করলেও নানা সীমাবদ্ধতা, অব্যবস্থা ও সামাজিক অবহেলার কারণে এটি শিক্ষার্থীদের জন্য একপ্রকার বোঝায় পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এই শিক্ষার্থীদের প্রতি প্রচলিত বৈষম্যমূলক মনোভাব। এই মনোভাব শিক্ষার্থীদের আত্মসম্মানবোধে আঘাত হানে, ফলে তারা পড়াশোনাকে গর্বের বিষয় হিসেবে না দেখে কেবল সনদ অর্জনের মাধ্যম হিসেবে ভাবতে শুরু করে।

ডিগ্রী কোর্সের সেশনজট থেকে বৈষম্য

ডিগ্রি কোর্সের অন্যতম বড় সমস্যা হলো সেশনজট এবং সময়মতো পরীক্ষা না হওয়া। শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা ও অনলাইনে পাওয়া অভিযোগ ঘেঁটে দেখা যায়, তিন বছরের এই কোর্স শেষ করতে অনেক সময় চার-পাঁচ বছর বা তারও বেশি সময় লেগে যায়। ফলাফল প্রকাশে দেরি, পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন, খাতা পুনর্মূল্যায়ন ইত্যাদি কারণে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে শুধু পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ নষ্ট হয় না, তাদের কর্মজীবন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ডিগ্রি শিক্ষার্থীদের জন্য নিয়মিত ক্লাসও প্রায় নেই বললেই চলে। দেশের অনেক কলেজে পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকা, শিক্ষকদের গাফিলতি এবং দুর্বল পাঠদান ব্যবস্থার কারণে শিক্ষার্থীরা নির্ভর করে মুখস্থ বিদ্যার উপর। ফলে প্রকৃত জ্ঞান বা দক্ষতার চেয়ে সনদই মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষার মান যেখানে কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকে, সেখানে ছাত্রছাত্রীদের আত্মবিশ্বাস ও ক্যারিয়ারের সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া খুবই স্বাভাবিক।

আরও কষ্টের বিষয় হলো, একই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স কোর্সের শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা পায়। যেমন : নিয়মিত ক্লাস, ভালো শিক্ষক, ক্লাস টেস্ট, সেমিনার, উপস্থাপনা, প্রজেক্টের মাধ্যমে বাস্তব জ্ঞান অর্জনের সুযোগ। অনার্সের একটি স্পষ্ট লক্ষ্য থাকে, নির্দিষ্ট বিষয়ের গভীর জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন। অথচ ডিগ্রি পাস কোর্সে শিক্ষার উদ্দেশ্যই স্পষ্ট নয়। এখানে কেবল ‘সাধারণ’ সনদ দেওয়াই মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়, ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞান অর্জনের আগ্রহ তৈরি হয় না; বরং তারা এটিকে সময় পার করার মাধ্যম হিসেবে দেখে। শিক্ষাপ্রণালীর যদি কোনো লক্ষ্যই না থাকে, তাহলে সেই পড়াশোনার মানও থাকে না, বরং তা শিক্ষার্থীদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে।

চাকরির বাজারেও ডিগ্রি পাস শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব কম। অনেক সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে স্পষ্টভাবে অনার্স বা বিশেষায়িত ডিগ্রিধারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। যোগ্যতা পূরণ করলেও ডিগ্রি পাস শিক্ষার্থীদের ‘কম যোগ্য’ হিসেবে দেখা হয়। ফলে প্রতিযোগিতা হয়ে ওঠে অসম ও হতাশাজনক। এই অবমূল্যায়ন শিক্ষার্থীদের মধ্যে হীনমন্যতা তৈরি করে, যা তাদের স্বপ্ন, সৃজনশীলতা ও আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে দেয়। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, এই কোর্সের নেতিবাচক দিকগুলো একসময় শিক্ষার্থীদের এমন মানসিক অবস্থায় নিয়ে যায়, যেখানে তারা নিজেদের লক্ষ্য সীমিত করে শুধু সনদ পাওয়ার মধ্যেই। ফলে সৃজনশীলতা, নেতৃত্বগুণ, বিশ্লেষণী ক্ষমতা বা বাস্তব জীবনের জন্য দরকারি দক্ষতার বিকাশ আর হয় না।

অনলাইনে শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন সংবাদ বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট বোঝা যায়, ডিগ্রি কোর্সের বর্তমান কাঠামো সময়োপযোগী নয় এবং বাস্তব জীবনের চাহিদা পূরণেও অকার্যকর। শুধু সনদ বিতরণে সীমাবদ্ধ এই কোর্স কর্মসংস্থান বা দক্ষতা বৃদ্ধিতে কোনো ইতিবাচক অবদান রাখছে না। বরং বৈষম্য, সেশনজট, পরীক্ষা অনিয়ম, সমাজের নেতিবাচক মনোভাব এবং চাকরির বাজারে অবমূল্যায়ন, সব মিলিয়ে এই কোর্স শিক্ষার্থীদের উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি করছে।

তাই সময় এসেছে নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই ডিগ্রি (পাস) কোর্সটি বন্ধ করে এর পরিবর্তে সময়োপযোগী, দক্ষতাভিত্তিক ও গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষাপদ্ধতি চালু করার। তবেই শিক্ষার্থীরা কেবল সনদ নয়, বাস্তব জ্ঞান, দক্ষতা ও মর্যাদা সবই অর্জন করতে পারবে আর অর্থহীন এই শিক্ষার খেলায় আটকে না থেকে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়তে পারবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ